বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
‘ইয়াস’ ঝড় নিয়েও দিল্লি–কলকাতা দ্বন্দ্ব। সেজন্য অবশ্য পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দায়ী করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং থেকে শুরু করে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। মমতার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও।
যদিও মমতা এদিন প্রধানমন্ত্রীর কাছে ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন। দিঘার জন্য ১০ হাজার কোটি এবং সুন্দরবনের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ দাবি করেছেন। অন্যদিকে, ইয়াসের প্রত্যক্ষ আঘাত গিয়েছে যে রাজ্যের ওপর দিয়ে, সেই ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক বলেছেন, ‘অতিমারির জন্য গোটা দেশই আজ মহাসমস্যার মধ্যে রয়েছে। তাই ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ওডিশার জন্য কেন্দ্রের কাছে কোনও ক্ষতিপূরণ আমি চাইছি না। আমাদের যে রসদ রয়েছে, তা দিয়েই আমরা এই ক্ষতিপূরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
যদিও প্রধানমন্ত্রী ওডিশার জন্য প্রাথমিক ভাবে ৫০০ কোটি এবং ২৫০ কোটি করে বাংলা ও ঝাড়খণ্ডের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ে মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে সাহায্য দেওয়ার কথাও বলেছেন। পাশাপাশি জাতীয় অর্থ কমিশনের কাছে বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার সুপারিশও করবেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
শুক্রবার আকাশপথে ওডিশা এবং পশ্চিমবাংলার ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি দেখেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য। এর পর দুপুরে কলাইকুণ্ডা বিমানবন্দরে একটি পর্যালোচনা বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। ছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় এবং রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তবে সেই বৈঠকে যোগ দেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ বৈঠকে তাঁর পাশাপাশি থাকার কথা ছিল রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। তিনিও বৈঠকে যোগ দেননি। সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই নাকি মুখ্যসচিব প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে যোগ দেননি।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে জানানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষা করেন। কিন্তু ৩০ মিনিট পর সেখানে এসে বৈঠকে যোগ না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান তুলে দেন মমতা। ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণও দাবি করেন। তার পরই তিনি সেখান থেকে চলে যান।
অন্যদিকে, নবান্ন সূত্রে পাল্টা দাবি করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নির্ধারিত সময়ের ২০ মিনিট পরে কলাইকুণ্ডায় পৌঁছবেন বলে নাকি তাঁর দফতরের তরফে জানানো হয়। তাই মমতা সাগরের প্রশাসনিক বৈঠক শেষ করে হেলিকপ্টারে কলাইকুণ্ডায় রওনা হন। তার পর তাঁকে নাকি কলাইকুণ্ডায় অবতরণের জন্য আকাশে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। তার পর দিঘায় মুখ্যমন্ত্রীর নাকি পূর্বনির্ধারিত বৈঠক ছিল। তাই বিশেষ অনুমতি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ক্ষয়ক্ষতির নথি তুলে দেন।
এদিকে, রাজ্যের মুখ্যসচিবের বৈঠকে যোগ না দেওয়া নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ওই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরই আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লি থেকে তলব করা হয়। বলা হয়েছে, ৩১ মে তাঁকে দিল্লিতে হাজিরা দিতে হবে। এবার দিল্লিতেই তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাঁর কর্মস্থল হবে দিল্লির নর্থ ব্লকে কর্মিবর্গ মন্ত্রকে। পাশাপাশি রাজ্য সরকারকে বলা হয়েছে, ৩১ মে–র মধ্যে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছেড়ে দিতে হবে। ফলে দিল্লি–কলকাতার সম্পর্কে নতুন সঙ্ঘাত তৈরি হল বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর এদিনের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি পরিদর্শন নিয়ে সকাল থেকেই বিতর্ক তৈরি হয়। সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি লোকসভায় বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরি এবং রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু কয়েকদিন ধরে দিল্লিতে ব্যস্ত রয়েছেন অধীরবাবু। তাই তিনি বৈঠকে থাকতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। তবে শুভেন্দু বৈঠকে থাকার ব্যাপারে সম্মতি দেন।
আর সেখানেই অসন্তুষ্ট হন মমতা। শুভেন্দু থাকলে তিনি বৈঠকে যোগ দেবেন না বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়ে দেন। পরে অবশ্য তৃণমূল সূত্রে বলা হয়, শুভেন্দু এখনও বিরোধী দলনেতা, তা স্বীকৃত নয়। যদিও বিজেপি রিপোর্ট প্রকাশ করে জানায়, শুভেন্দু অধিকারীকেই বিধানসভার বিরোধী দলনেতা করা হয়েছে। এর পর বৈঠকে মমতা গরহাজির থাকায় স্বভাবতই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।
বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর না থাকার ঘটনায় মুখ খুলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মুখ্যমন্ত্রীর আচরণের সমালোচনা করে এক টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘আজ মমতাদির আচরণ অধোগতির নতুন স্তরে নেমেছে। ইয়াসের জন্য বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সময় তাঁদের পাশে আমাদের সকলেরই দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, দিদি নিজের দম্ভকে মানুষের কল্যাণেরও উপরে স্থান দিয়েছেন।’
মমতার সমালোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংও। টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘পশ্চিমবাংলায় আজ যা ঘটেছে, তা বাকরুদ্ধ করে দেয়। মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু আসলে কোনও ব্যক্তি নন, তাঁরা একটি সংস্থা। তাঁরা সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ। সেই শপথ নিয়েই তাঁরা পদে বসেছেন। তাই প্রধানমন্ত্রী যখন বিপর্যয়ের পর বাংলায় পৌঁছেছেন, তখন এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আচরণ সত্যিই কষ্ট দেয়। সাংবিধানিক কতর্ব্যের ওপর রাজনৈতিক ভেদাভেদকে এ ভাবে স্থান দেওয়ার একটি দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ হয়ে থাকবে এই ঘটনা। ব্যাপারটা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূল ভাবনাকে আঘাত করেছে।’
রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় বলেছেন, ‘পর্যালোচনা বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর আধিকারিকেরা যোগ দেননি। এটা আসলে সংবিধান এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেই বয়কট।’
মমতার সমালোচনা করেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডাও। তিনি বলেছেন, ‘একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এমন আচরণ সমর্থন করা যায় না। তাঁর আচরণ দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে নষ্ট করে দেওয়ার শক্তিকেই উৎসাহিত করবে। স্রেফ ইগোর কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে যোগ দেননি। তাঁর অনুপস্থিতি আসলে সাংবিধানিক রীতিকে হত্যার সমান।’
মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ‘ভারতের দীর্ঘদিনের সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য শুক্রবার ছিল একটি অন্ধকার দিন। ভুক্তভোগী বাংলার মানুষের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও একবার অসংবেদনশীলতা দেখালেন।’ শুভেন্দু আরও বলেছেন, ‘দেশের অ–বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে এর আগে প্রধানমন্ত্রী অনেকবার বৈঠক করেছেন। কিন্তু আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তেমন বৈঠকে যোগ দেন না।’